🔰 ভূমিকা: সংকটকালে উম্মাহর প্রতি আহ্বান
বাংলার পবিত্র ভূমি আজ এক নতুন পরীক্ষার সম্মুখীন। দীর্ঘদিনের এক স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়েছে গণমানুষের ঐতিহাসিক বিপ্লব, যা জাতির মাঝে এক নতুন ভোরের প্রত্যাশা জাগিয়েছিল। কিন্তু গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, সেই মুক্তির সুফল এখনো অধরা। ক্ষমতার পালাবদলের পর, পূর্ববর্তী শাসকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এক নতুন চক্রের উত্থান ঘটেছে, যারা নিজেদেরকে ন্যায় ও ইনসাফের ধারক দাবি করলেও তাদের কর্মে জুলুম ও অন্যায়ের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট। এই পরিস্থিতি জাতির জন্য এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত বহন করে।
বর্তমানে দেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছে, যার প্রধান উপদেষ্টা হলেন ডক্টর ইউনুস সাহেব । এই সরকার ৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে শপথ গ্রহণ করেছে এবং তাদের মূল অঙ্গীকার হলো ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় মৌলিক সংস্কার সাধন করা । তবে, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি , রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং এর সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে । একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার কোনো সরাসরি জনরায় নেই, তার পক্ষে কার্যকরভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং ব্যাপক সংস্কার সাধন করা কঠিন হতে পারে। এই দুর্বলতা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা তৈরি করছে এবং অন্যান্য শক্তিকে তাদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দিচ্ছে।
জনগণের মাঝে যে দলীয় শক্তির উত্থান হয়েছে, তাদের কাছ থেকে এমন আচরণ অপ্রত্যাশিত ছিল। এই শক্তি, যারা পূর্বে জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, তারাই এখন নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনে মত্ত। তাদের কার্যকলাপে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, গুম, হত্যা এবং আলেম-ওলামাদের প্রতি ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের মতো পূর্ববর্তী স্বৈরাচারী শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুনরায় দৃশ্যমান হচ্ছে। এটি কেবল একটি নির্দিষ্ট দলের সমস্যা নয়, বরং এটি একটি গভীরতর পদ্ধতিগত দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়, যেখানে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা এবং জবাবদিহিতার অভাব যেকোনো রাজনৈতিক শক্তিকে একই ধরনের দুর্নীতির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
সালতানাতে বাংলা কোনো সংকীর্ণ রাজনৈতিক দল নয়; এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, জুলুমের বিরুদ্ধে এক কালজয়ী আন্দোলনের নাম। এই আন্দোলনের লক্ষ্য কেবল ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, বরং বাংলার মাটিতে সত্যিকারের ইসলামী খিলাফাহ প্রতিষ্ঠা, যেখানে আল্লাহর আইন ও রাসূলের সুন্নাহর ভিত্তিতে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হবে। সালতানাতে বাংলা সেই সকল সত্যনিষ্ঠ মানুষের পক্ষে যারা সত্যিকারের ইসলামিক রাজনীতি করে এবং বাংলায় ইসলামী খিলাফাহ কায়েমের চেষ্টায় রত আছে। কালিমার পতাকা উড়বেই ইনশাআল্লাহ্।
এই ঘোর সংকটে, যখন মানব রচিত সকল তন্ত্র-মন্ত্র ব্যর্থ প্রমাণিত হচ্ছে, তখন মুসলিম উম্মাহর জন্য একমাত্র পথপ্রদর্শক হলো আল্লাহর কিতাব কুরআনুল কারীম এবং তাঁর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ। এ দুই মৌলিক উৎস থেকেই আমরা আমাদের করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা লাভ করতে পারি।
🔰 ইসলামী শাসনের মূলনীতি: আদল, আমানাহ ও জবাবদিহিতা
ইসলামী শাসনব্যবস্থা এমন কতগুলো মৌলিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত, যা মানবজাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে। এই নীতিগুলো হলো আদল (ন্যায়বিচার), আমানাহ (বিশ্বাস), জবাবদিহিতা, শুরা (পরামর্শ) এবং রহমত (দয়া)।
⭕ আল্লাহর নির্দেশিত ন্যায়বিচার (আদল) ও ভারসাম্যের গুরুত্ব: সকল সৃষ্টির প্রতি ইনসাফ প্রতিষ্ঠা
ইসলামে ন্যায়বিচার (আদল) শুধু একটি গুণ নয়, বরং তা আল্লাহ্ তা'আলার সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। আল্লাহ্ তা'আলা নিজেই ঘোষণা করেছেন, "নিশ্চয় আল্লাহ্ এক অণু পরিমাণও জুলুম করেন না" । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসে কুদসীতে এসেছে, عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فِيمَا رَوَى عَنِ اللَّهِ، تَبَارَكَ وَتَعَالَى أَنَّهُ قَالَ " يَا عِبَادِي إِنِّي حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِي وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا فَلاَ تَظَالَمُوا "হে আমার বান্দাগণ, আমি আমার নিজের উপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের মাঝেও তা হারাম করেছি, সুতরাং তোমরা একে অপরের উপর জুলুম করো না" হাদীস নং ৬৩৩৮, সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)। এই হাদীস জুলুমের প্রতি আল্লাহর চরম ঘৃণা প্রকাশ করে।
ন্যায়বিচার মহাবিশ্বের ভারসাম্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, وَ السَّمَآءَ رَفَعَهَا وَ وَضَعَ الۡمِیۡزَانَ "আল্লাহ্ আসমানকে সমুন্নত করেছেন এবং ভারসাম্যের পাল্লা স্থাপন করেছেন" [কুরআন ৫৫:৭]। এর অর্থ হলো তিনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছেন। আদল মানে প্রতিটি বস্তুকে তার সঠিক স্থানে রাখা, যা ভারসাম্য সৃষ্টি করে । এটি শুধুমাত্র অপরাধমূলক বিচার নয়, বরং সমাজে সুবিচার নিশ্চিত করা, যাতে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের অধিকার সুরক্ষিত থাকে । আল্লাহ্ তা'আলা নির্দেশ দিয়েছেন, اِنَّ اللّٰهَ یَاۡمُرُكُمۡ اَنۡ تُؤَدُّوا الۡاَمٰنٰتِ اِلٰۤی اَهۡلِهَا ۙ وَ اِذَا حَكَمۡتُمۡ بَیۡنَ النَّاسِ اَنۡ تَحۡكُمُوۡا بِالۡعَدۡلِ "নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদেরকে আদেশ করেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তার হকদারদের কাছে ফিরিয়ে দাও এবং যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে" [কুরআন ৪:৫৮]। এমনকি নিজের, পিতা-মাতা বা নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে গেলেও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে । কুরআন আরও নির্দেশ দেয়, یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا كُوۡنُوۡا قَوّٰمِیۡنَ لِلّٰهِ شُهَدَآءَ بِالۡقِسۡطِ ۫ وَ لَا یَجۡرِمَنَّكُمۡ شَنَاٰنُ قَوۡمٍ عَلٰۤی اَلَّا تَعۡدِلُوۡا ؕ اِعۡدِلُوۡا ۟ هُوَ اَقۡرَبُ لِلتَّقۡوٰی "কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। সুবিচার করো, এটি তাকওয়ার নিকটতর" [কুরআন ৫:৮]। ইসলামে ন্যায়পরায়ণতা কেবল বাহ্যিক কর্ম নয়, বরং আত্মার পরিশুদ্ধি ও চরিত্রের উৎকর্ষের সাথেও জড়িত ।
⭕ নেতৃত্বের আমানাহ (বিশ্বাস) ও আল্লাহর কাছে তাদের জবাবদিহিতা
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে, শাসন ক্ষমতা একটি আমানাহ বা আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব। শাসকগণ জনগণের উপর প্রভুত্ব করার জন্য আসেন না, বরং তাদের সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । আল্লাহ্ তা'আলা বলেছেন, "হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্ ও রাসূলের সাথে খেয়ানত করো না এবং তোমাদের আমানতসমূহে জেনে-শুনে খেয়ানত করো না" । এই আমানাহর কারণে শাসকগণকে তাদের প্রতিটি কাজের জন্য আল্লাহর কাছে এবং জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে । হযরত আবু বকর (রা.) খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পর বলেছিলেন, "আমাকে তোমাদের উপর কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে, অথচ আমি তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নই। যদি আমাকে ভালো কাজ করতে দেখো, তবে আমাকে সাহায্য করো; আর যদি আমাকে ভুল করতে দেখো, তবে আমাকে শুধরে দিও। যতক্ষণ আমি আল্লাহর আনুগত্য করব, ততক্ষণ তোমরা আমার আনুগত্য করবে; আর যখন আমি আল্লাহর অবাধ্য হব, তখন আমার প্রতি তোমাদের কোনো আনুগত্য নেই" । এটি নেতৃত্বের প্রতি বিনয় এবং জবাবদিহিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইসলামী শাসনব্যবস্থায়, আইন সবার জন্য সমান, ধনী বা বংশমর্যাদা আইনের প্রয়োগে কোনো প্রভাব ফেলবে না ।
⭕ শাসকদের দায়িত্ব ও প্রজাদের অধিকার: ইসলামী শরীয়াহর আলোকে
ইসলামী শরীয়াহ শাসক ও শাসিতের অধিকার ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। শাসকদের কর্তব্য হলো জনগণের জানমাল, ইজ্জত ও দ্বীন রক্ষা করা, তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং তাদের উপর জুলুম না করা । শাসকদের উচিত প্রজাদের প্রতি দয়ালু ও সহানুভূতিশীল হওয়া, কঠোরতা পরিহার করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, "নম্রতা যা কিছুর সাথে যুক্ত হয়, তাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে; আর যা কিছু থেকে তা বিচ্ছিন্ন হয়, তাকে ত্রুটিপূর্ণ করে তোলে" । প্রজাদের অধিকার হলো ন্যায়বিচার পাওয়া, নিরাপত্তা ভোগ করা, এবং তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ হওয়া । ইসলামী শাসনব্যবস্থা জনকল্যাণকে (Maqasid al-shariah) সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়, যা মানবজাতির কল্যাণ নিশ্চিত করার মৌলিক লক্ষ্য ।
⭕ শুরা (পরামর্শ) ও রহমত (দয়া)-এর অপরিহার্যতা: আদর্শ ইসলামী সমাজের ভিত্তি
ইসলামী শাসনে শুরা বা পরামর্শের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ্ তা'আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ দিয়েছেন, وَ شَاوِرۡهُمۡ فِی الۡاَمۡرِ "এবং তাদের সাথে বিষয়ে পরামর্শ করুন" [কুরআন ৩:১৫৯]। পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে তা সমাজের জন্য কল্যাণকর হয় এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। রহমত বা দয়াও ইসলামী শাসনের একটি মৌলিক নীতি। আল্লাহ্ তা'আলার রহমত তাঁর সবচেয়ে বেশি উল্লিখিত গুণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, "পৃথিবীতে যারা আছে তাদের প্রতি দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন" মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) হাদীস নং ৪৯৬৯। একটি ইসলামী সরকার ক্ষমা ও সহানুভূতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে, যা সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য ।
এই ইসলামী শাসনতান্ত্রিক নীতিগুলো বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে একটি গভীর বৈপরীত্য তুলে ধরে। যখন কুরআন ও সুন্নাহ ন্যায়বিচার, আমানাহ, জবাবদিহিতা, শুরা এবং রহমতের মতো উচ্চতর নৈতিক মানদণ্ড স্থাপন করে, তখন বর্তমান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর কার্যকলাপে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন এবং আলেম-ওলামাদের প্রতি ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের মতো অন্যায়গুলো ইসলামী মূল্যবোধের চরম লঙ্ঘন হিসেবে প্রতীয়মান হয়। এই বৈপরীত্য কেবল বর্তমান ব্যবস্থার ত্রুটিই প্রকাশ করে না, বরং সালতানাতে বাংলার ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার আহ্বানকে আরও জোরালো করে তোলে। এটি জনগণের জন্য একটি স্পষ্ট মানদণ্ড তৈরি করে, যার মাধ্যমে তারা বর্তমান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর কর্মকে বিচার করতে পারে এবং সত্যিকারের ইসলামিক শাসনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারে।
🔰 জুলুম ও স্বৈরাচারের স্বরূপ: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ও বর্তমানের চিত্র
জুলুম, অর্থাৎ অন্যায়, অবিচার ও সীমালঙ্ঘন, ইসলামের দৃষ্টিতে এক জঘন্যতম অপরাধ। এর আভিধানিক অর্থ 'অন্ধকার' (যুলমাহ্)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, الظُّلْمُ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ "নিশ্চয়ই জুলুম কিয়ামতের দিন অন্ধকার হয়ে দেখা দেবে" হাদীস নং, ২৪৪৭ সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)। এটি কেবল দুনিয়াতেই নয়, বরং আখিরাতেও জালেমদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। আল্লাহ্ তা'আলা জালেমদের ভালোবাসেন না এবং জালেমদের কর্ম সম্পর্কে তিনি উদাসীন নন; বরং তিনি তাদের কেবল অবকাশ দেন সেই দিন পর্যন্ত, যেদিন চোখগুলো বিস্ফারিত হয়ে যাবে । এটি জালেমদের জন্য এক কঠিন সতর্কবাণী যে, তাদের প্রতিটি অন্যায়ের হিসাব নেওয়া হবে। মজলুমের দু'আ বা ফরিয়াদ সরাসরি আল্লাহর আরশে পৌঁছে, এর মাঝে কোনো পর্দা থাকে না । সুতরাং, প্রতিটি নাগরিকের উচিত মজলুমের পাশে দাঁড়ানো, তাদের কণ্ঠস্বর হওয়া এবং তাদের জন্য দু'আ করা।
⭕ বর্তমান পরিস্থিতি: পূর্ববর্তী স্বৈরাচারের পদাঙ্ক অনুসরণকারী শক্তির অপকর্ম
আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, যে শক্তি পূর্বে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলেছিল, আজ তারাই ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে পূর্ববর্তী জালেমদের পথ অনুসরণ করছে। তাদের কর্মে সেই স্বৈরাচারী শাসনের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, যা থেকে জাতি মুক্তি চেয়েছিল। এই ঘটনাপ্রবাহ স্পষ্ট করে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটি গভীর পদ্ধতিগত সমস্যা বিদ্যমান। ক্ষমতায় যেই আসুক না কেন, জবাবদিহিতার অভাব এবং ক্ষমতার লোভ তাদের একই ধরনের দুর্নীতি ও সহিংসতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এটি কেবল একটি নির্দিষ্ট দলের আদর্শিক ব্যর্থতা নয়, বরং এটি একটি পুনরাবৃত্তিমূলক চক্রের অংশ, যা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত।
⭕ ব্যবসায়ী সোহাগের শাহাদাত ও চাঁদাবাজির ভয়াবহতা: জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত
পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ব্যবসায়ী সোহাগকে নির্মমভাবে পাথর দিয়ে থেঁতলে হত্যা করা হয়েছে । এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড চাঁদাবাজি ও স্থানীয় স্ক্র্যাপ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধের ফল । এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে পাঁচজন গ্রেপ্তার হয়েছে, যাদের মধ্যে প্রধান সন্দেহভাজন মাহমুদ হাসান মহিন । তদন্তে দেখা গেছে, এই হত্যাকাণ্ডের সাথে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠনের কর্মীরা জড়িত ছিল, যাদের মধ্যে দুজনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে । এটি প্রমাণ করে যে, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা এই দলীয় কর্মীরা কীভাবে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। এই ধরনের ঘটনা প্রমাণ করে যে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি হয়েছে, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ । এই হত্যাকাণ্ড কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর চিত্রের অংশ যেখানে এই দলের নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভূমি দখল এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িত । গত ১১ মাসে ৩৪৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৩২৩টির সাথে এই দলটি এবং তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো জড়িত ছিল । এমনকি, তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেও অসংখ্য মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে । এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে দলীয় শীর্ষ নেতৃত্ব 'জিরো টলারেন্স' নীতি গ্রহণের কথা বললেও এবং ৫,০০০ এরও বেশি সদস্যকে বহিষ্কার করলেও, মাঠ পর্যায়ে এর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ । এই পরিস্থিতি ইঙ্গিত করে যে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে, তা জনগণের জানমালের নিরাপত্তা এবং দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে।
⭕ আলেম-ওলামাদের প্রতি ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও উম্মাহর বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা: দ্বীনের প্রতি আঘাত
অতি সম্প্রতি, জনৈক নেতা (ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক) প্রকাশ্যে চরমোনাই পীর সাহেবকে আক্রমণ করে অশালীন ও হুমকিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন । ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং এটিকে দেশের রাজনীতিকে কলুষিত করার ও চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের উসকে দেওয়ার শামিল বলে অভিহিত করেছে । এই ধরনের আচরণ শুধু আলেম-ওলামাদের প্রতি অশ্রদ্ধা নয়, বরং এটি মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা। ইসলামে আলেমদের সম্মান ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা অপরিহার্য। দ্বীনের ধারক-বাহকদের প্রতি এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ কোনো ইসলামী দলের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। চরমোনাই পীর সাহেব নিজেই রাজনৈতিক মতানৈক্যকে সংলাপ ও আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন, যা এই ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত । এই ঘটনাটি কেবল শারীরিক সহিংসতা ও দুর্নীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সমাজের নৈতিক ভিত্তি এবং ধর্মীয় কর্তৃত্বের উপরও আঘাত হানে। এটি ইঙ্গিত করে যে, এই রাজনৈতিক শক্তিটি কেবল অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ চায় না, বরং তারা সমাজের নৈতিক দিকনির্দেশনাকেও প্রভাবিত করতে চায়, যা পূর্ববর্তী স্বৈরাচারী শাসনের ভিন্নমত দমনের কৌশলের প্রতিধ্বনি।
⭕ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও জনমনে অস্থিরতা: সমাজের অস্থিরতা ও নৈরাজ্য
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে । রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, প্রতিশোধ গ্রহণ, দলীয় কমিটি নিয়ে বিরোধ, চাঁদাবাজি এবং ভূমি দখলের ঘটনায় সহিংসতা বাড়ছে । এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি জনগণের মনে গভীর অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতি স্পষ্ট করে যে, কেবল ক্ষমতার হাতবদল নয়, বরং একটি মৌলিক ব্যবস্থার পরিবর্তন অপরিহার্য, যা সত্যিকারের ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।
⭕ ক্ষমতার মোহ ও তার পরিণতি: ইবলিসের পদাঙ্ক অনুসরণ
ক্ষমতার মোহ মানুষকে অন্ধ করে দেয় এবং ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্য ভুলিয়ে দেয়। যারা আল্লাহর বিধান ও রাসূলের সুন্নাহ থেকে বিচ্যুত হয়ে ক্ষমতার লোভে জুলুমের পথ অবলম্বন করে, তারা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। এই পথ দুনিয়া ও আখিরাতে ধ্বংস ডেকে আনে। বর্তমান পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে, একটি রাজনৈতিক শক্তি, এমনকি যখন তারা ক্ষমতার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পায়নি, তখনো তারা ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে পূর্ববর্তী স্বৈরাচারী শাসনের মতোই অন্যায় ও জুলুমের পথ বেছে নিচ্ছে। এটি একটি সতর্কবার্তা যে, যদি এই শক্তি পূর্ণ ক্ষমতায় আসে, তবে তাদের কার্যকলাপ আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এই পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ দেখায় যে, সমস্যাটি কেবল ব্যক্তি বা দলের নয়, বরং এটি একটি কাঠামোগত দুর্বলতা যা জবাবদিহিতা ও নৈতিকতার অভাবের কারণে যেকোনো শক্তিকে স্বৈরাচারী করে তুলতে পারে।
🔰 উম্মাহর করণীয়: অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও সত্যের পথে অবিচলতা
এই ঘোর সংকটে, যখন জুলুম ও অন্যায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তখন মুসলিম উম্মাহর জন্য কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। এই দিকনির্দেশনাগুলো কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক।
⭕ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার (সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ)-এর ফরযিয়াত: ঈমানের দাবি
মুসলিম উম্মাহর অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হলো সৎকাজের আদেশ দেওয়া এবং অসৎকাজের নিষেধ করা। এটি ঈমানের অপরিহার্য দাবি এবং মুসলিম জাতির বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ্ তা'আলা কুরআনুল কারীমে বলেছেন, "তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ দাও এবং অসৎকাজের নিষেধ করো" । এবং "আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীগণ একে অপরের বন্ধু। তারা সৎকাজের আদেশ দেয় এবং অসৎকাজের নিষেধ করে" । এর উদ্দেশ্য হলো সমাজ থেকে জুলুম দূর করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা । এই দায়িত্ব পালনে পুরুষ ও নারী উভয়ই সমানভাবে অংশীদার । ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় – সকল স্তরে এই নীতি প্রয়োগ করতে হবে । এই নীতি কেবল একটি ধর্মীয় উপদেশ নয়, বরং এটি একটি কার্যকর সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার, যা মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে উৎসাহিত করে।
⭕ প্রতিবাদের স্তরসমূহ: হাত, জিহ্বা, অন্তর – প্রজ্ঞা ও ধৈর্যের সাথে
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيمَانِ "তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোনো মন্দ কাজ দেখবে, সে যেন তা নিজ হাত দ্বারা পরিবর্তন করে দেয়; যদি সে এতে সক্ষম না হয়, তবে নিজ জিহ্বা দ্বারা (কথা বলে); আর যদি সে এতেও সক্ষম না হয়, তবে নিজ অন্তর দ্বারা (ঘৃণা করে)। আর এটি ঈমানের দুর্বলতম স্তর" সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৯।
✅ 'হাত দ্বারা পরিবর্তন' বলতে ক্ষমতা থাকলে শক্তি প্রয়োগ করে অন্যায় দমন করা বোঝায়, যেমন একটি ন্যায়পরায়ণ সরকার বা একটি ইসলামী আন্দোলন করে থাকে। এটি ইসলামী খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জুলুমের মূল উৎপাটনের চূড়ান্ত লক্ষ্যকে নির্দেশ করে।
✅ 'জিহ্বা দ্বারা পরিবর্তন' বলতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা, প্রতিবাদ করা, লেখনীর মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং মজলুমের পক্ষে দাঁড়ানো বোঝায় । এটি ব্যবসায়ী সোহাগের শাহাদাত এবং আলেম-ওলামাদের প্রতি ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের মতো বর্তমান অন্যায়গুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান।
✅ 'অন্তর দ্বারা পরিবর্তন' বলতে অন্যায়কে অন্তর থেকে ঘৃণা করা এবং তা থেকে নিজেকে দূরে রাখা।
তবে এই প্রতিরোধ প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সাথে হতে হবে, যাতে একটি ছোট অন্যায় দূর করতে গিয়ে আরও বড় ফিতনা বা বিপর্যয় সৃষ্টি না হয় । এই স্তরবিন্যাস মুসলিমদের জন্য একটি ব্যবহারিক কাঠামো প্রদান করে, যার মাধ্যমে তারা বর্তমান নিপীড়নের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে সাড়া দিতে পারে, এবং এটি সালতানাতে বাংলার আন্দোলনের জন্য একটি নৈতিক ও কৌশলগত দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
⭕ মজলুমের দু'আর শক্তি: আল্লাহর আরশের কম্পন
মজলুমের দু'আ বা ফরিয়াদকে আল্লাহ্ তা'আলা সরাসরি কবুল করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, اتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ فَإِنَّهَا لَيْسَ بَيْنَهَا وَبَيْنَ اللهِ حِجَابٌ "মজলুমের দু'আকে ভয় করো, কারণ তার এবং আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা থাকে না" সহীহ বুখারি, হাদিস নং ২৪৪৮। সুতরাং, প্রতিটি নাগরিকের উচিত মজলুমের পাশে দাঁড়ানো, তাদের কণ্ঠস্বর হওয়া এবং তাদের জন্য দু'আ করা। আল্লাহ তা'আলা মজলুমের ফরিয়াদ কবুল করেন, এমনকি যদি সে অবিশ্বাসীও হয় । এই বিষয়টি মজলুমদের জন্য এক বিশাল শক্তি এবং জালেমদের জন্য এক কঠিন সতর্কবাণী।
⭕ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান: বিভেদ পরিহার করে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরা
আল্লাহ্ তা'আলা বলেছেন, وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰهِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا "তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না" [কুরআন ৩:১০৩]। বর্তমান পরিস্থিতিতে, যখন জালেম শক্তি মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করছে (যেমন আলেমদের প্রতি ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ), তখন ঐক্যবদ্ধ থাকা অপরিহার্য। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও সংঘাত পরিহার করে সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা উচিত, যেমনটি চরমোনাই পীর সাহেব আহ্বান করেছেন । উম্মাহর ঐক্যই জুলুমের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার।
⭕ ইসলামী খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার পথে অবিচল থাকা: উম্মাহর চূড়ান্ত লক্ষ্য
মুসলিম উম্মাহর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো আল্লাহর জমিনে তাঁর খিলাফাহ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে ন্যায়, শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজ করবে। খিলাফাহ হলো এমন একটি শাসনব্যবস্থা যা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে পরিচালিত হয় এবং জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করে । এটি এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে শরীয়াহর প্রাধান্য থাকবে এবং শাসক আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে কাজ করবেন । এই লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকা এবং এর জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো প্রতিটি মুমিনের দায়িত্ব। বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার বারবার ব্যর্থতা এবং জুলুমের পুনরাবৃত্তি প্রমাণ করে যে, মানব-রচিত তন্ত্র-মন্ত্র স্থায়ী সমাধান দিতে অক্ষম। তাই, আল্লাহর নির্দেশিত খিলাফাহই একমাত্র পথ, যা জাতিকে এই চক্র থেকে মুক্তি দিতে পারে।
🔰 অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান: ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর ইউনুস সাহেব, জনগণের গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন । তাদের মূল অঙ্গীকার ছিল একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা এবং মৌলিক সংস্কার সাধন করা । এই সরকার একটি অসাংবিধানিক কাঠামোতে কাজ করছে এবং সাংবিধানিক বৈধতার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন । এই পরিস্থিতি একটি ক্ষমতাশূন্যতা তৈরি করে, যা অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিকে অবৈধ পন্থায় প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দেয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই দুর্বলতা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাদের সংগ্রাম চলমান অন্যায় ও দুর্নীতির একটি কারণ।
⭕ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেওয়া: জনগণের আস্থা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত আল্লাহর কাছে তাদের আমানাহর (দায়িত্ব) কথা স্মরণ করা। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ যেন জনগণের আস্থা অর্জন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে পরিচালিত হয়। শাসক হিসেবে তাদের দায়িত্ব হলো ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা, যা ইসলামী শাসনের মূল ভিত্তি । তাদের উচিত এই সংকটময় মুহূর্তে দেশের সকল নাগরিকের প্রতি ন্যায়পরায়ণ আচরণ করা এবং কোনো প্রকার পক্ষপাতিত্ব থেকে বিরত থাকা।
⭕ স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার গুরুত্ব
সরকারকে অবশ্যই সকল কার্যক্রমে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে । আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না । বিশেষ করে, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, গুম, হত্যা এবং আলেম-ওলামাদের প্রতি অসম্মানজনক আচরণের মতো অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ও নিরপেক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, তারা যে দলেরই হোক না কেন । অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, যা তাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ । এই পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা অপরিহার্য। তাদের ব্যর্থতা দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে এবং জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করতে পারে।
⭕ ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান: শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য
যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি অসাংবিধানিক কাঠামোতে কাজ করছে, তবুও তাদের উচিত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। আলেম-ওলামাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখা শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা কর্তৃক আলেমদের প্রতি ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য (যেমন জনৈক নেতার চরমোনাই পীর সাহেবকে আক্রমণ) কঠোরভাবে দমন করা উচিত এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত । সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের অভাব রয়েছে । সরকারকে সকল পক্ষের সাথে পরামর্শ (শুরা) করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, যাতে দেশের ভবিষ্যৎ পথ সুগম হয়।
🔰 উপসংহার: কালিমার পতাকা উড়বেই ইনশাআল্লাহ্
আল্লাহ তা'আলা তাঁর কিতাবে বারবার সত্যের বিজয় এবং মিথ্যার পরাজয়ের ওয়াদা করেছেন। وَ قُلۡ جَآءَ الۡحَقُّ وَ زَهَقَ الۡبَاطِلُ ؕ اِنَّ الۡبَاطِلَ كَانَ زَهُوۡقًا "সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয় মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল" [কুরআন ১৭:৮১]। মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব হলো এই সত্যের পথে অবিচল থাকা, সকল জুলুম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। আমাদের মনে রাখতে হবে, দুনিয়ার সকল ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহ। তিনিই যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নেন। قُلِ اللّٰهُمَّ مٰلِكَ الۡمُلۡكِ تُؤۡتِی الۡمُلۡكَ مَنۡ تَشَآءُ وَ تَنۡزِعُ الۡمُلۡكَ مِمَّنۡ تَشَآءُ ۫ وَ تُعِزُّ مَنۡ تَشَآءُ وَ تُذِلُّ مَنۡ تَشَآءُ ؕ بِیَدِكَ الۡخَیۡرُ ؕ اِنَّكَ عَلٰی كُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ [কুরআন ৩:২৬]।
সালতানাতে বাংলা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, বাংলার এই পবিত্র ভূমিতে ইসলামী খিলাফাহ কায়েম হবেই ইনশাআল্লাহ্। এটি কেবল একটি স্বপ্ন নয়, বরং আল্লাহর ওয়াদা এবং রাসূলের সুন্নাহর বাস্তবায়ন। খিলাফাহ এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা, মানবতা এবং আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে । এটি একটি এমন রাষ্ট্র যা শরীয়াহর আলোকে পরিচালিত হবে এবং জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করবে । আমরা আল্লাহর কাছে সাহায্য ও তৌফিক কামনা করি, যেন এই মহান লক্ষ্য অর্জনে আমরা সফল হতে পারি।
হে বাংলার সম্মানিত নাগরিকগণ! এই কঠিন সময়ে আপনারা ধৈর্য ধারণ করুন এবং আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখুন। সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, গুম, হত্যা এবং আলেম-ওলামাদের প্রতি অসম্মানজনক আচরণ থেকে নিজেদের দূরে রাখুন এবং এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকুন, আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরুন এবং বিভেদ পরিহার করে ঐক্যবদ্ধ হোন।
মনে রাখবেন, দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী ক্ষমতার মোহ মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়, কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের সাফল্যই প্রকৃত সফলতা। কালিমার পতাকা উড়বেই ইনশাআল্লাহ্! আল্লাহ্ আমাদের সহায় হোন। আমীন।
রেটিং: ⭐ 0.0/5